রাখাল || মো. আরিফুল হাসান
রাখাল ||  মো. আরিফুল হাসান

রাখাল তার বাঁশিটি রাখলো আর অমনি সবকিছু আবার ঠিকঠাক। সে দেখতে পেলো মাঠে মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে গবাদীগুলো, সবুজ লকলকে ঘাসগুলো ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে দাঁত দিয়ে। আকাশে শাদা মেঘ, সেখানে নানান জাতের পাখিরা উড়াউড়ি করছে। দুইটি চিলকে সে দেখতে পেলো মেঘের উপর পাখা মেলে দিয়ে ভাসছে। কোনো ডানা ঝাপটাচ্ছে না। তার কাছে মনে হলো যেনো চিলদুটি মেঘের ভেলায় ভেসে যাচ্ছে মনের আনন্দে। সে আবার তার বাঁশিটি হাতে নিলো। মুখে লাগিয়ে সুর তুললো যেইমাত্র অমনি আবার সবকিছু পাল্টে যেতে আরম্ভ করলো। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এলো আকাশ। তার সামনে থেকে দিগন্ত বিস্তারী মাঠটি কুয়াশায় ঢেকে যেতে যেতে একসময় মিলিয়ে গেলো। পশ্চিম আকাশে একটি চাঁদ উঁকি দিয়ে আবার ডুবে গেলো নিমেষে। আকাশে একটিও তারা নেই। সে যেখানে বসে আছে তার অস্তিত্বও সে ভুলে যেতে থাকলো। সেই বটগাছটা, ডালপালা ছড়ানো সুবিস্তৃত বটগাছটার ঝুল, সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকলো। এমনকি তার পায়ের নিচের মাটির অস্তিত্বও সে ভুলে গেলো। তার কাছে মনে হতে থাকলো সে শুন্যে ভাসছে। ভয়ানক অন্ধকার এক শূণ্যে, যার কোনো শুরু নেই কিংবা নেই যার কোনো প্রকার শেষ।


এমন সময় শুনতে পেলো কেউ একজন তাকে ডাকছে, সুমধুর কিন্নর কণ্ঠে ডাকছে তার নাম ধরে। অসীম অন্ধকার থেকে সেই রমনীয় ডাক রাখালের হৃদয়ের ভেতরে গিয়ে কি এক অনুপম দোলা জাগালো তা তার বর্ননার অসাধ্য। চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করলো রাখাল। কিন্তু নিঃসীম জমাট অন্ধকার ছাড়া তার চোখে আর অন্যকিছু ধরা দিলো না। রাখাল ভাবলো একটু এদিক ওদিক ঘুরলে হয়তো সে আহ্বানকারী রমনীর সংস্পর্শ পেতে পারে। তাই সে পা বাড়ালো নিঃসঙ্গ সে অন্ধকারের কোনো প্রকার দিক নির্র্ণয় ছাড়াই। আর তখনই এক আশ্চর্য বিষয় ঘটে গেলো। রাখাল অনুভব করতে লাগলো সে ছুটছে প্রাণপণে অথবা মহাকাল যেনো ছুটে চলছে তার পাশ দিয়ে প্রচÐ গতিবেগ নিয়ে। শো শো শো শো আওয়াজ ছাড়া আর অন্যকিছু সে অনুভব করতে পারছে না। ইতিমধ্যে তার বাঁশিটিতেও বাজছে এক প্রাণকাড়া সুর, সে সেই সুরকে থামাতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে সুর থামিয়ে দিলে তার হৃৎপিণ্ড থেমে যাবে, সে আর শুনতে পাবে না সেই কিন্নর কণ্ঠের ডাক। রাখাল বুঝতে পারলো না সে কি করবে। কিছু না ভেবেই সে হঠাৎ তার বাঁশিটিকে সরিয়ে নিলো মুখের কাছ থেকে। আর আবার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলো মুহুর্তেই। সে দেখতে পেলো ঘাসের উপর উড়ে বেড়াচ্ছে ফড়িংগুলো। রং বেরঙের প্রজাপতিরা উড়ে বসছে ঘাস ফুলে ফুলে। দুয়েকটা শালিক খুঁটে খাচ্ছে দানা। দুয়েকটি কাক উড়ে বসছে হাল দেয়া খেতের উপর। রাখাল আবার তার বাঁশিটিকে ঠোঁটে ছোঁয়ালো। ফুৎকার করতে যাবে এমন সময় থেমে গেলো। না আজ আর সে বাঁশিটি বাজাতে চায় না। সে মনে করে বাঁশিটি বাজালেই সে আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে। বাঁশিটি বাজালেই সে আবার হারিয়ে ফেলবে তার চেনা জগৎ।

রাখাল আঙুল উঁচিয়ে তার গবাদিগুলোকে গণনা করলো। না, ঠিক আছে। রাখালের মনে হয়েছিলো যখন তার মাথার উপর দিয়ে, চারপাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো মহাকাল অথবা সে নিজেই ছুটছিলো প্রচÐ গতিতে তখন হয়তো তার গবাদিগুলো হারিয়ে গিয়েছিলো কোথাও। না, সবই তো ঠিক আছে। সেই দিগন্ত বিস্তারী মাঠ, সেই চেনা বটগাছ, বটগাছের অসংখ্য ঝুল যেগুলোকে এখন বৃক্ষ বলেই মেনে নিতে হয়, --সেসবের সবকিছুই ঠিক আছে। রাখাল তার পাগরিতে হাত বুলায়, হ্যা, ভালো করেই বাঁধা আছে গামছাটা। অথচ যখন সে অন্ধকারে ছুটছিলো ঝড়োর্ধ্ব গতিতে তখন তার মনে হয়েছিলো তার সমস্ত অস্তিত্ব যেনো ছিড়ে ছিড়ে ছুটে যাচ্ছে সংযুক্তি থেকে। রাখাল ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। আবার সে ভয় পায়নিও। সে সেই কিন্নর কণ্ঠের জন্য মেনে নিয়েছিলো সমস্ত প্রকার অন্ধকার-ভয়, সমস্ত প্রকার ঝড় ও তাণ্ডবের দৌরাত্ম। রাখাল এবার ভাবে, আজ তার এমন হচ্ছে কেনো? সে তো প্রতিদিনই এখানে পশু চড়াতে আসে আর বরাবরের মতোই দিনশেষে পশুগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় তার মালিকের খামারে। সেখানে তার রাতের খাবার শেষে শুয়ে পড়ে চিটচিটে কাথার বিছানায়। আর রাতের বেলা ঘুম ভেঙে গেলে একমাত্র সঙ্গী বাঁশিটিতে সুর তুলে। আজও তো সে তেমনি সকাল হলে হাতমুখ ধুয়ে, পান্তা খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে, তারপর খুলে দিয়েছে পশুগুলোর বাঁধন। তারপর ওদের লাগামগুলো বেঁধে দিয়েছে ভালো করে যেনো কোনো ফসলি জমিতে মুখ দিতে না পারে কোনো পশু। তারপর তাদেরকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে মাঠে, খুলে দিয়েছে মুখের লাগাম আর নিজে এসে বসেছে বটের ছায়ায়।

রাখাল দেখতে পায় তার ছাব্বিশটি ছোট বড় গবাদি ঘাস খাচ্ছে আপন মনে। তাদের কোনো প্রকার খেয়াল নেই এতকিছুতে। এই যে এতকিছু ঘটে গেলো, এই যে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো, শূন্য-মর্তের প্রভেদ ঘুঁচে গেলো, --এসব এই অবলা চারপেয়োরা মোটেই টের পায়নি যেনো। এমনকি আকাশের পাখি, বটের পাতারাশি, কিংবা উড়ে চলা ফড়িঙ-প্রজাপতিরাও টের পায়নি যেনো। তাহলে কি সে একাই অনুভব করেছে সেই নিঃসঙ্গ একাকীত্বের আঁধার? তাহলে কী তার এই যে বাঁশির সুরের সাথে সাথে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এটি শুধু তার কাছেই? রাখাল বুঝতে পারে না। সে বটের গুড়ি থেকে উঠে এলো। চারপাশে চোখ বুলালো। না কেউ আর নেই মাঠে, বেলা পড়ে এসেছে। রাখাল তার গবাদিগুলোকে অদ্ভুত শব্দে ডাকতে লাগলো। আর গবাদিগুলোও কী চমৎকার সাড়া দিয়ে জড়ো হলো একসাথে এসে। রাখাল তাদের মুখের লাগামগুলো আবার লাগিয়ে দিলো ভালোভাবে। তারপর হাতের লাঠিটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাদেরকে তাড়া করে নিয়ে গেলো গ্রামের দিকে।

খামারে ঢুকে রাখাল তার বাঁশিটি রাখলো। গবাদিগুলোকে বাঁধলো খুঁটির সাথে। তাদেরকে জল পান করালো আর তাদের সামনে ছড়িয়ে দিলো শুকনো বিচালি। রাখাল এবার হাতমুখ ধোয়ার জন্য পুকুরের ঘাটে যায়। পুকুরের পানিতে চোখ পড়া মাত্রই সে ভয়ানক আঁৎকে উঠে। এ কী! তার সারা মুখ এমন আঁচড়ে রেখেছে কে? সে দেখতে পায় তার সারা মুখ ফালা ফালা হয়ে আছে কোনো হিংস্র জন্তুর তিক্ষ্ন থাবার আচড়ে। সে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। কিন্তু না, হাতে কোনো জখমের চিহ্ন তার অনুভব হলো না। তেমনই মসৃণ ত্বক, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সবকিছুই ঠিকঠাক মনে হলো তার কাছে। সে ভয়ে ভয়ে মুখ থেকে হাত সরাতে চাইলো। কিন্তু মনের জোর পাচ্ছে না। সে যদি আবার দেখে তার মুখ আচড়ে আচড়ে রক্তাক্ত হয়ে আছে। কিংবা যদি সে আবার দেখতে পায় তার মুখের সেই গভীর ক্ষতগুলো, --তাহলে হয়তো সে আর সহ্য করতে পারবে না। তাই সে আর মুখ খুলতে চায়না হাতের বন্ধন থেকে। রাখাল তার আঙুলগুলোকে চালিয়ে মুখের পুরোটা অনুভব করার চেষ্টা করে। না কিছুই নেই। সে ভয়ে ভয়ে মুখ থেকে হাত সরায়। পানিটা কাঁপছে। কিন্তু তার ছায়া দেখা যাচ্ছে একদম স্পষ্ট। না কোনো ক্ষত নেই, কোনো রক্ত নেই, একদম ঠিকঠাক সবকিছু।

রাতের খাবার খেয়ে রাখাল ঘুমিয়ে পড়লো। হঠাৎ দরজার মধ্যে ধুমদাম শব্দে রাখালের ঘুম ভাঙলো। কেউ যেনো উন্মাদের মতো তার দরজায় ধাক্কাচ্ছে জোড়ে জোড়ে। হুরমুর করে রাখাল দরজা খুলে। ঘরের ভেতর প্রায় লাফিয়ে পড়ে তার মালিক গনু ভুইয়া। ‘‘সর্বনাশ হইয়া গেছে আমার! সর্বনাশ হইয়া গেছে! সুফিরে কোত্থাও পাওয়া যাইতেছে না।’’ রাখাল আন্দাজ করতে পারে না এখন রাত কয়টা বাজে। রাতের আঁধার দেখে অনুভূত হয় বারোটা কি একটা বাজে। গ্রামের রাতে এ বড় গভীর রাত। এতো গভীর রাতে মালিকের এমন উদ্বিগ্ন মুখ তার মনেও তড়াক করে ভয়ের সঞ্চার করে। রাখাল গনু ভুইয়ার সাথে বাইরে বের হয়। দুজনে দুটো টর্চ মেরে দেখতে থাকে নিস্তব্ধ রাতের আঁধার কেটে। ঝোপঝাড়, এ ঘর ও ঘরের চিপায় তারা সন্তর্পনে আলো ফেলে চলে। সুফিয়াকে কোথাও দেখা যায় না। ডাকাডাকি যে করবে সে অবস্থাও নেই। সোমত্ত মেয়ে, শেষে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। নিশ্চুপ চোরের মতো তারা আলো ফেলে ফেলে খুঁজে গ্রামের পরি নামে খ্যাত সুফিয়াকে।

ঘরে এসে গনু ভুইয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে যায়। তার স্ত্রী বার বার মূর্ছা যেতে থাকে। একমাত্র সন্তান সুফিয়া। বড় আদরের ধন। অনেক সাধনায় তাকে পেয়েছিলো তারা। বিবাহের দীর্ঘ উনিশ বছর পর। অনেক বদ্যি কবিরাজ, অনেক পির ফকিরের আশির্বাদের গুনের ধন সুফিয়া। বাবা মায়ের একমাত্র চোখের মণি। গ্রামের সমস্ত যুবকদের স্বপ্ন সুফিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। রাখাল কী করবে বুঝতে পারছে না। সে একবার তার মালিকের দিকে, একবার তার মালকিনের দিকে যুগপৎ খেয়াল রেখে চলছে। সেও বিহ্বল হয়ে পড়ছে প্রচÐভাবে। কি করবে বুঝতে পারছে না। গনু ভুইয়া মুখ ঢেকে হঠাৎ হুহু করে কেঁদে উঠে। গ্রামের কোথাও আর খুঁজতে বাকি নেই। আত্মীয়দের বাড়িতেও ফোন করা হয়ে গেছে। কোথাও নেই সুফিয়া। এতো রাতে গনু ভুইয়া কী করবে বুঝতে পারে না। শেষে, শেষরাতের দিকে, সবাই মনকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আগামীকাল সকালের অপেক্ষায় যার যার বিছানায় গেলো। বিছানায় গেলো কিন্তু ঘুমালো না কেউ। রাখালের চোখ থেকে যেনো সমস্ত ঘুম ছু মেরে নিয়ে গেছে কোনো হিংস্র চিল তার নখরে ধরে। যেমন করে মাঠের মধ্যে চিলগুলো লাফিয়ে পড়ে ইঁদুরগুলোর উপর আর পলকেই নখরে বিদ্ধ করে নিয়ে যায় শূন্য আকাশে। রাখাল কি করবে ভেবে পায় না। সে একবার তার বাঁশিটি হাতে নেয়। না, বাজাতে ইচ্ছে করছে না তার। এ অবস্থায় হয়তো বাঁশি বাজানো ঠিক নয় কিংবা এ অবস্থায় হয়তো বাঁশি বাজাতে পারলে তার একটু মানসযন্ত্রণার প্রশমন হতো। রাখাল বুঝতে পারে না কি করবে এখোন। সে বিছানা থেকে উঠে একবার গবাদিগুলোকে দেখে আসে। না, সব ঠিক আছে। গবাদিগুলো ঘুমোচ্ছে। মাঝে মাঝে লেজ নেড়ে মাছি তাড়াচ্ছে পিঠ থেকে। রাখাল আবার বিছানায় চলে আসে। না, আজ আর ঘুম আসবে না তার। তার মনে হলো ঘুম আসাটা অন্যায়। তার ঘুমালে চলবে না। সুফিয়া নেই! তার ভেতরটা কেমন যেনো হাহাকার করে উঠে।

সকাল হলে গনু ভুইয়া জানায় সে বিষ্ণুপুর যাচ্ছে। সেখানে তার বড় বোনের বাসা। রাত থেকে চেষ্টা করেও তাদেরকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই গনু ভুইয়া নিজেই একবার দেখে আসতে চায় গিয়ে। রাখাল যেনো তার কাজে চলে যায়, আর বৌকেও শাশিয়ে গেছে যেনো কান্নাকাটি না করে। পাড়া পড়শি জানতে পারলে সমাজে মুখ দেখানোর জো থাকবে না তার। গনু ভুইয়ার স্ত্রী মুখ ঢেকে কেঁদে উঠে। সকালে আর কিছু খায়নি রাখাল। গবাদিগুলোকে নিয়ে মাঠে চলে গেছে। অন্যান্য দিনের মতোই গবাদিগুলোর লাগাম খুলে দিয়ে গিয়ে বসেছে বটগাছের ছায়ায়। বটগাছের পাতারা যেনো হুহু করে কাঁদছে। পাতায় পাতায় বাতাসের কানে কানে কোন দুঃখের গোপন ঈঙ্গিত যেনো দিয়ে যাচ্ছে একাকী সময়। রাখাল তার গামছাটি খুলে নীরবে চোখ মুছে। তারপর পিঠের নিচে বিছিয়ে শুয়ে পড়ে বটের ছায়ায়। ঘুম ভেঙে দেখে অনেক বেলা হয়ে গেছে। সূর্য তার মাথার একদম উপরে। সে কি করবে ঠিক বুঝতে পারে না। বটের ঝুলে গুঁজে রাখা বাঁশিটি সে হাতে নেয়। তার ইচ্ছে হয় সেই নিঃসীম অন্ধকারে আবার হারিয়ে যেতে। সেই সুরের ভেতর, সেই কিন্নর কণ্ঠের ডাকের ভেতর, সেই অনন্তে বয়ে যাওয়া মহাকালের ভেতর তার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।

এদিকে হতাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে এসে গনু ভুইয়া একবার কি মনে করে রাখালের ঘরে যায়। আর ঘরে উঁকি দিয়েই তার চক্ষু বিস্ফারিত হয়। রাখালের ঘরে তীরের সাথে ঝুলে আছে সুফিয়ার লাশ। সমস্ত দেহ ছিন্নভিন্ন। মুখটা কোনো হিংস্র পশু যেনো পাষাণ নখরে আচড়ে আচড়ে বিক্ষত করে রেখেছে। চিৎকার করে উঠে গনু ভুইয়া। পাড়ার লোকেরা একত্রিত হয়। সবাই দা-বল্লম হাতে নিয়ে ছুটে মাঠের দিকে। মাঠের মাঝখানটায় বটগাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে রাখাল। তার চার পাশ থেকে দৃশ্যগুলো সব সরে সরে যাচ্ছে। সে দেখতে পায়, ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এসেছে আকাশ। তার সামনে থেকে দিগন্ত বিস্তারী মাঠটি কুয়াশায় ঢেকে যেতে যেতে একসময় মিলিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে একটি চাঁদ উঁকি দিয়ে আবার ডুবে গেছে নিমেষে। আকাশে একটিও তারা নেই। সে যেখানে বসে আছে তার অস্তিত্বও সে ভুলে যেতে থাকে।  নিঃসঙ্গ, গাঢ় এক অন্ধকার শূন্যতার ভেতর সে তার নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। হঠাৎ সে ডাক শনে সেই কিন্নর কণ্ঠের। এবার আর কণ্ঠটিকে অচেনা লাগে না তার কাছে। সে চিনতে পারে, --এটি সুফিয়ার কণ্ঠ! সুফিয়া ডাকছে তাকে। রাখাল তার কানদুটোকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এমন সময় তাকে আরো বিস্ময়ে ঠেলে দিয়ে অন্ধকারের গভীর থেকে একটি শ্বেত-শুভ্র গোলাপের মতো বেরিয়ে আসে সুফিয়া। রাখাল এবার তার চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে পারে না। সে প্রাণপণে বাঁশিটি বাজিয়ে চলে অমিয় সুরের ধারায়। গনু ভুইয়াই প্রথম আঘাতটি হানে রাখালের উপর, তার ছোড়া বল্লমটি এফোঁড় ও ফোঁড় করে দেয় রাখালের বুক। রাখাল দেখতে পায়, সুফিয়া তার হাত ধরে, দুজনে পা বাড়ায় দিকশূন্য কোনো অন্ধকারের অনন্ত শূন্যতায়। সাথে সাথেই তারা দুজনে তীব্র গতিতে ছুটতে থাকে সীমাহীন অন্ধকার দিগন্তের ওপার থেকে ওপার ডিঙিয়ে, কিংবা তাদের পাশ দিয়ে বর্ননাতীত গতিতে বয়ে যায় অদৃষ্টের বন্ধনে আঁকা মহাকাল। সাথে সাথে আরও অনেকগুলো অস্ত্র একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাখালের ভুলুণ্ঠিত দেহটির উপর। তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে সেই অমীয় সুরের বাঁশিটি।

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান